আশিক উদ্দিনঃ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন সাকিব আল হাসান! পোর্ট অব স্পেনে ২০০৭ বিশ্বকাপ জয় দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই বাঁহাতি শেষটাও রাঙালেন জয়ে। দিল্লিতে গত সোমবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের ম্যাচে সাকিবই ছিলেন বেশ উজ্জ্বল। এরপর জানা যায়, বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছেন চোটে। তাতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ অধ্যায় তার শেষ হয়ে গেল প্রায় নিশ্চিতভাবেই। কারণ পরবর্তী ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ২০২৭ সালে। ৪০ বছর বয়সে সেই বৈশ্বিক আসরে সাকিবের খেলা অনেকখানি অসম্ভব বলা যায়!
২০০৭ বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু করা সাকিব ২০১১, ২০১৫, ২০১৯ এবং ২০২৩ বিশ্বকাপ খেললেন। এই পাঁচ বিশ্বকাপ ইতিহাসে সাকিবই শ্রেষ্ঠতম অলরাউন্ডার। ৩৬ ম্যাচ খেলে ৪১.৬২ গড়ে ১৩৩২ রান তার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল ছয় ব্যাটার। বিশ্বকাপে অন্তত ১ হাজার রান করা ব্যাটারদের মধ্যে ৩০ উইকেটও নেই আর কারও।
বল হাতে সাকিবের উইকেট ৪৩টি। সব মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন কেবল ১০ জন বোলার। বিশ্বকাপে ৩০ উইকেট শিকারি বোলারদের মধ্যে ৭০০ রানও নেই অন্য কারও। ব্যাটে-বলে দ্যুতি ছড়িয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনি চার বার। যার সবশেষটি নিজের খেলা শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে। চলতি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগে হাসে নি সাকিবের পারফর্মেন্স।
ভারতে সাকিব ছিলেন না চিরচেনা ফর্মে। ফিরে এসেও খুব একটা ভালো কিছু হয়নি। দল বাদ পড়েছে আসর থেকে আগেই। টানা হারের বৃত্তে থাকা বাংলাদেশ যখন চরম বিপাকে, তখন অবশ্য জ্বলে ওঠেন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোলিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট, ব্যাট হাতে ৬৫ বলে ৮২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের আলোয় দলে হারের আঁধার কাটান তিনি। নিজের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে দলকে জিতিয়ে পান সেরার পুরষ্কার। যা বাংলাদেশের আর কেউ দুবারের বেশি পারেননি।
সাকিবের বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল ২০০৭ সালে। উদ্বোধনী ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৫৩ রানের এক ইনিংস। তা দিয়েই বিশ্বকে জানান দেন টাইগারদের আগামীর ভবিষ্যৎ তিনি। তারপর থেকে খেলেছেন টানা ৫টি বিশ্বকাপ। স্বপ্নের মতো আসর কেটেছিল ইংল্যান্ডে ২০১৯ সালে। সেই আসরে তার নামের পাশে ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট- এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আগে কখনোই কারও কাছ থেকে দেখেনি বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
২০১৯ আসরে উইন্ডিজের বিপক্ষে ১২৪ রানের অপরাজিত ইনিংসটাই সাকিবের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ। এই দলটার বিপক্ষেই ২০০৭ সালে তিনি শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন; যা তার এই টুর্নামেন্টের ক্যারিয়ারে একমাত্র ডাক। বিশ্বকাপে সাকিবের কীর্তির সাথে আছে কিছু ব্যর্থতাও। বিশেষ করে অধিনায়ক সাকিব খুব একটা সফল নন বিশ্ব মঞ্চে। ২০১১ বিশ্বকাপে তার কাঁধে নেতৃত্ব থাকা অবস্থায় ৫৮ ও ৭৮ রানের লজ্জার দুটি ইনিংসের মুখোমুখি হতে হয় বাংলাদেশকে।
এবারের বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে ফের সাকিবকে দেওয়া হয় অধিনায়কের দায়িত্ব। তামিম ইকবালকে ছাড়াই ভালো করবে তার দল এমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সাকিব। কিন্তু নিজে তো অফ ফর্মে গেছেনই, সঙ্গে পুরো দলও। তাই এবার হয়েছেন সমালোচিতও। তামিম না থাকায় সমর্থকদের দুয়ো শুনতে হয়েছে টুর্নামেন্টের মাঝপথে দেশে ফেরার পরে। এরপর নেদারল্যান্ডসের মতো দলের কাছে হারতে হয় সাকিবের দলকে। আসরে নিজে ৭ ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে ১৮৬ আর বোলিংয়ে ৯ উইকেট নিয়ে শেষ করলেন।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে সাকিবের আরও কিছু খুঁটিনাটি-
- বিশ্বকাপের একই ম্যাচে ফিফটি করা ও ৫ উইকেট নেওয়া দ্বিতীয় খেলোয়াড় সাকিব। ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫১ রানের ইনিংস খেলার পর ২৯ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ২০১১ সালের আসরে ভারতের যুবরাজ সিং ৩১ রানে ৫ উইকেট দখলের পর ৫০ রানে অপরাজিত ছিলেন।
- বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা বোলিং ফিগারের মালিক সাকিব। ২০১৯ সালে আফগানদের বিপক্ষে ১০ ওভারে একটি মেডেনসহ ২৯ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নেন তিনি।
- বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে ৫ উইকেট শিকারের প্রথম নজির গড়েন সাকিব (আফগানিস্তানের বিপক্ষে)। এই তালিকায় তিনি ছাড়া আছেন কেবল মোস্তাফিজুর রহমান (দুবার)। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৯ সালে টানা দুই ম্যাচে ৫ উইকেট করে পান তিনি।
- বাংলাদেশের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে সাকিবের। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২১ ও উইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৪ রান করেন তিনি।
- বিশ্বকাপের এক আসরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক সাকিব (৬০৬ রান)। দুইয়ে আছেন মুশফিকুর রহিম। ২০১৯ সালে তিনি ৮ ম্যাচে ৫২.৪২ গড়ে ৩৬৭ রান করেন।
- বিশ্বকাপের এক আসরে অন্তত ৬০০ রান করা ও ১০ উইকেট নেওয়া একমাত্র ক্রিকেটার সাকিব। ২০১৯ সালে ৮ ম্যাচে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান তোলার পাশাপাশি ৩৬.২৭ গড়ে ১১ উইকেট পান তিনি।
সাকিবের ৫ বিশ্বকাপ-
- ২০০৭ বিশ্বকাপে ২ ফিফটিতে সাকিব করেন ৯ ম্যাচে ২০২ রান। আর বল হাতে তার শিকার ৭ উইকেট।
- ২০১১ বিশ্বকাপে ২৪ বছর বয়সী সাকিবের কাঁধে ওঠে অধিনায়কত্বের ভার। মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা শেষ মুহূর্তে চোটের কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান। সাকিবের অধিনায়কত্বের ওই আসরে গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচে ৩ জয় পায় বাংলাদেশ। পরের রাউন্ডে না গেলেও ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে জয় পায় টাইগাররা। ওই আসরে সাকিবের ব্যাট থেকে আসে ৬ ম্যাচে ১৪২ রান। আর বল হাতে নেন ৮ উইকেট।
- ২০১৫ বিশ্বকাপে সাকিব ‘বিশ্বের সেরা’ অলরাউন্ডারদের একজন হিসেবে খেলতে যান। এই আসরে মাশরাফীর অধীনে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ৬ ম্যাচে করেন ১৯৬ রান আর বল হাতে শিকার ৮ উইকেট।
- ২০১৯ সালে সাকিব করেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডিং পারফর্মেন্স। ৯ ম্যাচে ৬০৬ রানের সঙ্গে উইকেট নেন ১১টি। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও সাকিব পুরো দুনিয়ার প্রশংসা পান। ৯ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ২ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটি। সেঞ্চুরি দুটি আসে ইংল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে।
- ২০২৩ বিশ্বকাপটা সাকিবের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো কাটছিল। প্রথম ৭ ম্যাচে ফিফটি তো দূরের কথা ব্যাট করাই যেন ভুলে গিয়েছিলেন। তবে শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৫ বলে ৮২ রান আর বল হাতে ২ উইকেট তাকে এনে দেয় ম্যাচ সেরার পুরস্কার। ৭ ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে ১৮৬ আর বোলিংয়ে ৯ উইকেট নিয়ে শেষ করলেন।
এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম/নিপ্র/১১০
Discussion about this post